'সব কিছুর দামই তো একটু একটু করে বাড়তাছে কিন্তু আমার আয় তো বাড়ে না'

 

'সব কিছুর দামই তো একটু একটু করে বাড়তাছে কিন্তু আমার আয় তো বাড়ে না'

দারিদ্র্যের চাপে নাভিঃশ্বাস রাজধানীর সাধারণ মানুষ

“করোনা দিয়া সেই যে ঝামেলা শুরু হইলো, আর ঠিক হইলো না। হের পর থেক্কাই আয় করি, ব্যয় করি, টিয়া দেহিনা,”—ঢাকার ছোলমাইদ এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ সোহেলের কণ্ঠে এভাবেই ফুটে উঠলো জীবনের অসহায় বাস্তবতা।

শুধু তিনি নন, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় রাজধানীতে তার মতো অসংখ্য মানুষ এখন আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

রিকশা চালিয়ে পরিবারের পাঁচজনের খরচ বহন করেন মোহাম্মদ বাবুল। প্রতিদিনের জমা-খরচ বাদে হাতে থাকে ৭০০–৮০০ টাকা। এর মধ্য থেকেই মাসে ১২–১৩ হাজার টাকা গ্রামে পাঠাতে হয়, যাতে দুই সন্তানের পড়ালেখা আর মায়ের চিকিৎসা চালানো যায়। কিন্তু ব্যাটারিচালিত রিকশার আধিক্যে আয় কমে গেছে, আর বাজারে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি তাকে ফেলেছে বড় চাপে।
“পোলাটা সেভেনে পড়ে। কিন্তু মনে হয় বেশিদিন স্কুলে যাওয়া হইব না,”—হতাশ গলায় বলেন তিনি।


দারিদ্র্যের হার বেড়ে ২৭.৯৩%

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে এসেছে, দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭.৯৩ শতাংশে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জরিপে এ হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ। অর্থাৎ তিন বছরে প্রায় ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠী নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।

পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান জানান, দেশের ৮ হাজার ৬৭টি পরিবারের ৩৩ হাজারেরও বেশি মানুষের ওপর ভিত্তি করে এই গবেষণা করা হয়েছে। এতে দেখা যায়—

  • শহরের মানুষের আয় কমেছে, কিন্তু খরচ বেড়েছে
  • গরিব পরিবারগুলো আয় ছাপিয়ে ব্যয় করছে, ফলে ঋণের বোঝা বাড়ছে
  • পরিবারের মোট খরচের প্রায় ৫৫ শতাংশই যাচ্ছে শুধু খাবারের পেছনে
  • শিক্ষা ও চিকিৎসা খরচও দ্রুত বাড়ছে

এছাড়া দারিদ্র্যসীমার বাইরে থাকা ১৮ শতাংশ মানুষও যেকোনো ধাক্কায় দারিদ্র্যের নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।


মাঠপর্যায়ের চিত্র

রাজধানীর রামপুরা, ভাটারা ও নতুনবাজার ঘুরে দেখা গেছে—বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে প্রতিদিনের দ্বন্দ্ব এখন দ্রব্যমূল্যকে ঘিরেই।

ভাটারা বাজারে এক ক্রেতার ক্ষোভ,
“ছোট্ট এক আটি শাকের দাম চল্লিশ টাকা! পটল ৮০, বরবটি ১০০ টাকা।”
বিক্রেতার সাফ জবাব,
“কি করমু, কেনা বেশিতে, তাই বিক্রিও বেশিতে।”

ভ্যানগাড়িতে ফল বিক্রি করা মিলন মাহমুদ জানান,
“মানুষ কিনে না। হাতে টাকাই নাই, আমার ইনকাম হইব কেমনে?”

অন্যদিকে নতুনবাজারে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গাড়ির সামনে ভিড় করে আছেন শত শত মানুষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে কিছুটা কম দামে পণ্য কিনতে চেষ্টা করছেন তারা।

সন্তানকে কোলে নিয়ে লাইনে দাঁড়ানো সালেহা বেগম বললেন,
“বাজার থেইকা কিনে খামু কেমনে, যে দাম! মাছ-মাংস খাওয়াই বন্ধ কইরা দিছি।”

রাজমিস্ত্রী মোহাম্মদ রুবেলও একই অভিযোগ করেন—
“চাল, ডাল, সবজি, মাছ-মাংস—সব কিছুর দাম বাড়তাছে। কিন্তু আয় বাড়ে না।”


অর্থনীতিবিদদের মতামত

বিশ্বব্যাংকও বলছে, বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার বাড়ছে এবং অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। সংস্থাটি অনুমান করছে, ২০২৫ সালে দেশে আরও ৩০ লাখ মানুষ অতি দারিদ্র্যের মধ্যে পড়তে পারে।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থানে কাঠামোগত পরিবর্তন না হওয়া এবং সামাজিক সুরক্ষায় দুর্বলতা—এই তিনটি কারণে দারিদ্র্য বেড়েছে।

অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন,
“দারিদ্র্য বিমোচনে যে অগ্রগতি হয়েছিল, সেটা মুছে গেছে। বরং নতুন করে দারিদ্র্যের বিস্তার ঘটছে।”


উপসংহার

মহামারি-পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির অভিঘাতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আজ এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি। আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য হারিয়ে তাদের নিত্যদিনের সংগ্রাম আরও কঠিন হয়ে উঠছে।

No comments

Powered by Blogger.